স্বাধীনতালাভের পঁচাত্তর বর্ষ পার হয়ে দেশে আজ প্রবল হয়েছে বিকশিত ভারতের আহ্বান।তবে এই সুদীর্ঘকালে আমাদের অর্জন যেমন উজ্জ্বল তেমনি ব্যর্থতাও কম নয়। অর্থনৈতিক উন্নতিতে আজ আমরা প্রথম সারিতে কিন্তু জনগণের সার্বিক উন্নয়নে দেশ এখনও বেশ পিছিয়ে।কারণ, উদ্দেশ্য মহৎ হলেও তার রূপায়ণের পথে আছে প্রবল বাধা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি– কবির কথাটি বোধ হয় আমাদের গণতন্ত্র সম্বন্ধে পুরোপুরি প্রযোজ্য। কেননা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র রূপে ভারতের স্থান সর্বাগ্রে।ক্রমবর্ধমান গণ বিস্ফোরণের প্রতাপে ভারত অবশ্যই এক নম্বরে। আবার এই গণতন্ত্র আকারে এক নম্বর হলেও প্রকারে কিন্তু ‘দু’ নম্বরী’। কেননা ভোটাভুটির আচারে ভারতে গণতন্ত্র সমুজ্জ্বল ঠেকলেও মূল্যবোধের বিচারে গণতন্ত্রের ফাঁকিটা ধরা পড়ে সহজেই।যথার্থ গণতন্ত্রের প্রাণপ্রতিষ্ঠার অভাবে গণতন্ত্রের বুলি আউড়ে সেটা ঢাকা দিতে আমরা সদা তৎপর। আমাদের গণতন্ত্রে জনগণকে বাদ দিয়ে শিবের অনুচর ‘গণ’ অর্থাৎ প্রমথবাহিনীর ভূতনৃত্যই যেন প্রবল। সেই জন্যই গণতন্ত্র এখন জনগণের কাছে এক প্রচন্ড কৌতুক।
উপনিষদে একটা কথা আছে—‘ক্রুতো স্মর, কৃতং স্মর’ অর্থাৎ কী করার কথা ছিল তা স্মরণ কর এবং কী করা হয়েছে তাও স্মরণ কর। স্বাধীনতার এই আটাত্তর বছর পরে আমাদেরও আজ সেই ফিরে দেখার দিন– কী প্রতিজ্ঞা আমরা শুরু করেছিলুম এবং আজ কোথায় এসে পৌঁছেছি।
স্বাধীনতা লাভের সেই শুভলগ্নে নব অরুণোদয়ের আলোয় এক বৈতালিক সুরে আমাদের ঘুম ভেঙেছিল। প্রথম প্রভাতের সেই সুর এখনো কানে বাজে— “পনেরাই আগস্ট পূণ্য দিন, প্রাচীন ভারতে জাগে নবীন, গাও তিনরঙা পতাকার তলে, নবভারতের ঐকতান।” অবশ্যই তার মধ্যে কোনও উৎকৃষ্ট কাব্যমহিমার স্পর্শ ছিল না, কিন্তু সেদিন এর নতুন জাগা চেতনায় একটা প্রাণের আবেগ ছিল। সংসদে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কথায়, Awakening of a new Nation in an ancient land-এর A Tryst with Destiny –এর উচ্চারণে এক অমিত সম্ভাবনার আশ্বাস ছিল। তারপর রাজনৈতিক বন্ধুর পথের মধ্যে দিয়ে আজ দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত। উপনিষদে একটা কথা আছে—‘ক্রুতো স্মর, কৃতং স্মর’ অর্থাৎ কী করার কথা ছিল তা স্মরণ কর এবং কী করা হয়েছে তাও স্মরণ কর। স্বাধীনতার এই আটাত্তর বছর পরে আমাদেরও আজ সেই ফিরে দেখার দিন কী প্রতিজ্ঞা আমরা শুরু করেছিলুম এবং আজ কোথায় এসে পৌঁছেছি।
স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও বিধেয় সুনির্দিষ্ট করে আমাদের সংবিধানে গৃহীত হয়ে ভারতকে একটি Sovereign Republic রূপে ঘোষণা করা হয়, যেখানে People বা Citizen -দের সার্বভৌম অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু অনুবাদের সময় দেখা গেল,আমাদের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্তার মধ্যে British Subject খোঁয়াড়ি না ভাঙার ফলে Republic -এর অনুবাদে দাঁড়াল প্রজাতন্ত্র।অর্থাৎ Republic -এর Citizen আর Monarchy এর Subject -এর মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেকথা তাদের খেয়ালই রইল না। সেইজন্যই বোধহয় আমাদের গণতন্ত্রে এখনো Ruler রাজার দাপটে Ruled প্রজাদের প্রাণান্তকর অবস্থা।আলোচনা করলে দেখা যাবে একইভাবে আমাদের রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য এবং তার বাস্তব প্রয়োগে কত পার্থক্য।তার প্রধান কারণ মহৎ উদ্দেশ্য এবং তার বাস্তবায়নের সর্ষের মধ্যেই ভন্ডামির ভূত ঢুকে বসে আছে।
আসলে আমাদের সংবিধানকে সকলেই কথায় কথায় মহাপবিত্র দিশারী বলে উল্লেখ করলেও, কার্যক্ষেত্রে সেই সংবিধানের Letter and Spirit কে ধ্বংস করাই আমাদের ইতিহাস হয়ে উঠেছে। তাই শাসকগোষ্ঠীর যখনই প্রয়োজন হয়েছে, তখনই সংবিধানের বিধিবদ্ধ ধারাকে দিয়ে মূল ভাবকে লঙ্ঘন করাই একটা অলিখিত নিয়মরূপে দেখা দিয়েছে।যেমন আমাদের রাজ্যসভা ‘কাউন্সিল অফ স্টেটস’-এর প্রাথমিক নিয়ম ছিল, সদস্যরা তাঁদের যে যার রাজ্য থেকে নির্বাচিত হবেন।কিন্তু সেই ধারাকে বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠ দেখিয়ে আমাদের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় গুজরাতের প্রতিনিধি হয়েছিলেন এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং হয়েছিলেন অসমের প্রতিনিধি।এরা যে চরম কপটতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা যদি চাকরির ইন্টারভিউ-এর মতো ৫ মিনিট তাদের প্রতিনিধিত্ব করা রাজ্যের ভাষায় বলতে বলা হত, তাহলেই তাঁরা ধরা পড়ে যেতেন।কিন্তু এঁরাই হয়েছিলেন সাংবিধানিক সর্বোচ্চ পদের অধিকারী।পরে অবশ্য সেই বেআইনকে আইন করার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।
শাসক দলের সুবিধার্থে আরও একটি সংবিধান লঙ্ঘনের নিদর্শন হল, যখন কংগ্রেস, সিপিএম তথা অন্যান্য মহান নেতারা Office of Profit -এর নামে নিয়মের ফাঁদে ধরা পড়েন, তখন এইসব অপরাধী মহামতিরা একযোগে একটি সংবিধান সংশোধনের বিল সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করেন এবং সেটি অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের কাছে পাঠান। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কালাম ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’ মনে করে সেই অন্যায়কে অনুমোদন করতে অস্বীকার করেন।তখন কংগ্রেসি সোনিয়াজি থেকে মার্কসবাদী সোমনাথজি – সকলেই একযোগে রাষ্ট্রপতি কালামকে অনুমোদনে বাধ্য করেন, সেই বেআইনকে আইনে পরিণত করতে। সুচিন্তিতভাবে বিধিবদ্ধ আমাদের এই সংবিধানকে শাসককুলের অপকর্মের অনুগামী করতে ‘সংবিধান সংশোধনী’ আজ প্রায় শতাধিক। সংবিধান নয় রাজনৈতিক দূরভিসন্ধিমূলকভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করার ফলে, সংবিধানে Checks and Balance -এর ব্যবস্থা ছিল, সেটি নষ্ট হওয়ার পরিণতি হয়ে উঠেছে ভয়াবহ।
সংবিধানের Preamble -এ বলে আছে আমরা ভারতবাসীরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভারতকে একটি Sovereign, Socialist, Secular, Democratic Republic রূপে গড়ে তোলার জন্য। যার মূল উদ্দেশ্য হল ফরাসি বিপ্লবের অর্জন – Liberty, Equality, Fraternity -এর সঙ্গে সংযুক্তভাবে যুক্ত করা হয়েছে Justice. কারণ Justice তথা ন্যায়বিচার না থাকলে অপর তিনটি অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে। সংবিধানে আবার প্রতিটি উদ্দেশ্যকে অত্যন্ত সুসংগতভাবে বিশ্লেষিত করা হয়েছে।
যেমন Justice (Social, Economic, Political),Liberty (of thought, expression, belief, faith and worship), Equality (of status, of opportunity and to promote among them all), Fraternity (assuring the dignity of the individual and the unity and integrity of the Nation). আমাদের সংবিধানের মূল উপাদানের উদ্দেশ্যগুলি যেভাবে স্পষ্টভাষায় বিশ্লেষিত করা হয়েছে, সেটি যথাযথভাবে অনুশীলন এবং অনুসরণ করলেই আমাদের রাষ্ট্রের মহিমা এতদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারত। কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি করে কথার মারপ্যাঁচে, সেগুলির সঙ্গে সজ্ঞানে তঞ্চকতা করা হয়ে এসেছে বলেই, আজকে আমাদের এই বিশৃঙ্খল অপূর্ণ অবস্থা।
আমাদের সংবিধানের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য সার্বভৌম লোকতন্ত্রের যে মূল পরিচয় পাওয়া যায়, তা যথাযথ রূপায়ণে বিচ্যুতি আমাদের আজকের জাতীয় সমস্যাকে ডেকে এনেছে। মূলত সোস্যালিস্ট ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক গঠনের ডাক থাকলেও সেখানেই হয়ে গিয়েছে ভাবের ঘরে চুরি।যেমন আমাদের ভারতীয় সোস্যালিজম কেমন হবে তার কোন স্পষ্ট রূপরেখা নির্দেশ করা হয়নি।
কিন্তু সেই বিচ্যুতি সত্ত্বেও অস্বীকার করার উপায় এই আটাত্তর বছরে আমাদের গর্বের অর্জনও কিছু কম নয়। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন, এমনকী ‘স্বৈরাচারী’ ইন্দিরা গান্ধির পতন, তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলির মধ্যে বিশিষ্টতায় অনন্য। দ্বিতীয়তঃ সমস্ত ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও আমাদের এক একজন প্রধানমন্ত্রী এক একদিকে ক্রান্তদর্শী ভূমিকা পালন করে দেশগঠনের ভিত্তিকে সমৃদ্ধ করেছেন। যেমন প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু স্বভাবে স্বেচ্ছাতন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও দেশে ব্রিটিশ ধারায় লিবারাল ডেমোক্রেসির যে ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন, তা দেশে গভীর শিকড় সঞ্চার করেছে এতদিনে। স্বল্পকালীন হলেও লাল বাহাদুর শাস্ত্রী শিল্পসর্বস্ব নীতি থেকে ‘জয় জওয়ান জয় কিষান’ স্লোগানের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ও কৃষির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি জরুরি অবস্থার বিচ্যুতি সত্ত্বেও খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা এবং বাংলাদেশ সৃষ্টিতে যুদ্ধবাজ পাকিস্তানকে পর্যুদস্ত করে বিশ্বে ভারতের সম্মান বৃদ্ধি করেন।অন্যদিকে তরুণ আধুনিকমনস্ক রাজীব গান্ধি, দেশে কম্পিউটার টেলিকম বিপ্লবের নায়ক হিসেবে আধুনিকতার অগ্রদূত। প্রাজ্ঞ নরসিমা রাও দেশকে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নতুন অর্থনৈতিক জমানার সৃষ্টি করেন। বিচক্ষণ অটলবিহারী বাজপেয়ি প্রথম বিরোধী সমন্বয়কে নিয়ে একটি সুস্থিত অকংগ্রেসি সরকার প্রতিষ্ঠা করে কাশ্মীরের জনগণের আস্থা অর্জন করেন এবং চতুষ্কোণ সড়ক পরিবহন প্রকল্পে সারাদেশকে যোগাযোগ ব্যবস্থার সূত্রে গেঁথে তোলার চেষ্টা করেন। সজ্জন মনমোহন সিং প্রক্সি প্রধানমন্ত্রীর হেনস্থা সহ্য করা সত্ত্বেও আমেরিকার সঙ্গে নিউক্লিয়ার চুক্তি, সর্বশিক্ষা অভিযান, আধার কার্ড, গ্রামীণ রোজকার যোজনা এবং জিএসটি প্রকল্পের শুভ সূচনা করেন।বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর কিছু না হোক তাঁর স্বচ্ছ ভারত অভিযান, জনধন প্রকল্প, গ্রামীন সাক্ষরতা, গ্রামীণ স্বাস্থ্য, গ্রামীণ বিদ্যুৎ প্রকল্প যদি সফল করে তুলতে পারেন তাহলে গ্রামভিত্তিক ভারতের এক সমৃদ্ধ রূপ দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা এই সম্মিলিত প্রয়াসে জনসংখ্যা ১৩০ কোটিতে দাঁড়ালেও দেশে খাদ্য এবং অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের কোনও অভাব নেই। যদিও বন্টন ব্যবস্থা ত্রুটির জন্য অনাহারে,অপুষ্টিতে মৃত্যুকে এখনও রোধ করা যায়নি।তবে ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রচলনে সে সমস্যার সমাধান হতে পারে কিনা তারই অপেক্ষায় দেশ।
বলে রাখা ভালো, জনতার স্বর্গ বলে বিশ্বে প্রচারিত সোভিয়েত রাশিয়া যেমন মিনিমাম ফর এভরিওয়ান সুনিশ্চিত করা, চন্দ্রাভিযান, আণবিক বোমার সক্ষমতায় বিশ্বের অন্যতম প্রবল সামরিক শক্তি হওয়া সত্ত্বেও বিরাট সাম্রাজ্যে আভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করতে না পারায় ইন্টার কনট্রাডিকশনে আপনিই ভেঙে পড়েছে – আমরাও যদি ভ্রষ্ট রাজনীতিতে বিশ্বাসঘাতক, তঞ্চক, বাহুবলীদের প্রতাপ রোধ করতে না পারি, তাহলে আমাদেরও সমূহ সর্বনাশ।
আমাদের সংবিধানের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য সার্বভৌম লোকতন্ত্রের যে মূল পরিচয় পাওয়া যায়, তা যথাযথ রূপায়ণে বিচ্যুতি আমাদের আজকের জাতীয় সমস্যাকে ডেকে এনেছে। মূলত সোস্যালিস্ট ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক গঠনের ডাক থাকলেও সেখানেই হয়ে গিয়েছে ভাবের ঘরে চুরি।যেমন আমাদের ভারতীয় সোস্যালিজম কেমন হবে তার কোন স্পষ্ট রূপরেখা নির্দেশ করা হয়নি। সোভিয়েত রাশিয়ার নাম সোস্যালিস্ট রিপাবলিক হলেও সেখানে সোস্যালিজমের নামে আসলে ছিল ক্রীতদাসের রাজত্বে স্ট্যালিনের মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ।আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সৌখিন সোস্যালিস্ট। নেহরুর প্রেরণা ছিল ব্রিটেনের ফেবিয়ান সোস্যালিজম। সেই জন্য সোস্যালিজম প্রতিষ্ঠায় শেষ পর্যন্ত তিনি দেশে সোস্যালিস্টক প্যাটার্ন অফ সোসাইটি নির্মাণ করতে গিয়ে বাস্তবে ফিউডাল সোস্যালিজমকে ডেকে আনেন। আজ আমাদের দেশে শেষ পর্যন্ত সোস্যালিজমের পরিচয় হয়ে ওঠে ‘বকচ্ছপ’ সামন্ততাত্বিক সোস্যালিজম।
নেহরুজির মিক্সড ইকোনমির জাঁতাকলে পড়ে দেশের অর্থনীতির শম্বুকগতি অবশেষে প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের হাতে আসার পরে অর্থনীতির রাহুমুক্তি ঘটে।যদিও বামপন্থীরা তখনও সোস্যালিস্ট অর্থনীতির খোয়াব দেখতে ব্যস্ত। কিন্তু এইসব জ্ঞানান্ধদের বোঝায় কে যে, সেই আত্মঘাতী খোয়াব কমিউনিজমের পিতৃভূমি সোভিয়েত রাশিয়া এবং মাতৃভূমি কমিউনিস্ট চিনেও কবে পরিত্যক্ত হয়েছে।
আসলে আমাদের সংবিধান ‘সোস্যালিস্ট’ এবং ‘ডেমোক্রেটিক’ কথাটা একসঙ্গে থাকায় হয়তো মনে হতে পারে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজম’ যাকে কট্টরপন্থীরা সোনার পাথরবাটি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অবহেলিত বামপন্থী চিন্তাবিদ Rosa Luxemburg -এর মতো তাত্ত্বিকরা স্পষ্ট বলেছেন, গণতান্ত্রিকতাই সোস্যালিজম প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত। আমরা তত্ত্বের গোলকধাঁধায় না গিয়ে যদি যেভাবে আরম্ভ করেছিলুম, সেই গণতান্ত্রিকতাকে সত্য আচরণের দ্বারা যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম তাহলেও একটা দিশা মিলতে পারত। কিন্তু আমরা গণতন্ত্রে পরিবারতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়, সেই গণতন্ত্রের মূলেই কুঠারাঘাত করেছি। ফলে নেহেরু-গান্ধি পরিবার দিয়ে যার শুরু এখন দেশের দিকে দিকে সামন্ততন্ত্রের মতো গণতান্ত্রিক পরিবার গড়ে উঠেছে উত্তরাধিকার সূত্রে।বিহারের যাদব পরিবার, উত্তরপ্রদেশে যাদব পরিবার, পাঞ্জাবের বাদল পরিবার, তামিলনাড়ুর করুনানিধি পরিবার, মহারাষ্ট্রের পাওয়ার ও থ্যাকারে পরিবার, মধ্যপ্রদেশের সিন্ধিয়া পরিবার প্রভৃতি ডেমোক্রেটিক রাজপরিবার গণতান্ত্রিক Fiefdom চালিয়ে আসছে।ফলে ভারতের বিচিত্র ‘ডাইন্যাসটিক ডেমোক্রেসি’ জাজ্বল্যমান হয়ে উঠেছে।
এই ‘ডাইন্যাস্টিক ডেমোক্রেসি’-এর নাটের গুরু হলেন নেহরুতনয়া ইন্দিরাজি। তিনি ছিলেন একাধারে মুর্তিমতী ‘ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড’। দেশে তার সদর্থক কার্যকলাপে জাতি সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু দেশের সমস্ত নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নষ্ট করে তিনি সুস্থ গণতন্ত্রের যা ক্ষতি করে গিয়েছেন যার ফল ভুগতে হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মকে। ভোট ভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ইন্দিরা গান্ধির অক্ষয়কীর্তি সংবিধানের Preamble সংশোধন করে Secular কথাটির সংযোজন করা। তার মূল উদ্দেশ্য, স্পষ্টতই কার্যে সেকুলারিজমের ঢক্কানিনাদের আড়ালে ভোটভিক্ষার সুবিধার্থে সম্প্রদায় বিশেষকে তোষন করা। সেকুলার কথাটির আভিধানিক অর্থ ধর্মরহিত তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধর্মব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীন।যদিও পাশ্চাত্যে একাধিক রাষ্ট্রে খিস্টধর্ম রাষ্ট্রধর্ম রূপে স্বীকৃত। কিন্তু তা নিয়ে রাষ্ট্র বা জনগণের মধ্যে কোন মাতামাতি নেই।
আসলে সেকুলারিজম ভারতীয় অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা।স্ব স্ব ধর্মাচরণের অধিকার ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার রক্তে।তার অন্যতম পরিচয় পাওয়া যায় বাংলায় ৪০০ বছরের পাল বংশের বৌদ্ধ রাজত্বে।কারণ ধর্মসহিষ্ণুতা ছিল ভারতীয় জীবনচর্চার অঙ্গ। সেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংবিধানের ‘সেকুলার’ কথাটি সংযোজনের পরেই দেখা যায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ধান্দাবাজির পরিচয়।
ভারত আবহমান কাল ধরে একটি ধর্মপ্রধান দেশ হলেও সেখানে যুগ যুগ ধরে ধর্মসহিষ্ণুতা বিরাজ করছে। এমনকী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মাচরণে কোনওরকম হস্তক্ষেপ না করে। ভারত শুধু ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বলেই ক্ষান্ত হয়নি ইতিহাসের ধারা বেয়ে অত্যাচারিত ভিন্নধর্মী ইহুদি, খ্রিস্টান, আর্মেনিয়ান, পারসিক, বৌদ্ধ (তিব্বতি) ও মুসলমান (বাংলাদেশি)প্রভৃতিদের উদার আশ্রয় দিয়েছে। শুধু তাই নয়, আধুনিক হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বিশ্বধর্মসভায় বলে এসেছেন ‘যত মত তত পথ’ (ধর্মক্ষেত্রে) এবং হিন্দুভারত ধর্মান্তরে বিশ্বাস করে না।ইতিহাসের পথ বেয়ে ভারত সেকথা উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হয়নি যুগ যুগ ধরে আচরণের দ্বারা তা প্রমাণ করেছে।
তাছাড়া ভারতীয় রাষ্ট্রের সংবিধানের মুখবন্ধে যেখানে স্পষ্ট করে Liberty কে(of thought, expression, belief, faith and worship)বলে বিশ্লেষিত করা হয়েছে – ধর্মের ব্যাপারে ব্যক্তির অধিকারে ও Justice অংশে বিশ্লেষিত করা হয়েছে (Social, Economic, Political) বলে, সেখানে Secular কথাটির সংযোজন বাহুল্যমাত্র বলে তা বর্জন করা হয়েছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধি এবং তাঁর স্তাবকবৃন্দ সংবিধানের অপরিবর্তনীয় অংশে Secular কথাটি যোগ করে যে অপরাধমূলক নজির সৃষ্টি করলেন, তাকে বাধা দেওযার ক্ষমতা কারই বা ছিল?
আসলে সেকুলারিজম ভারতীয় অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা।স্ব স্ব ধর্মাচরণের অধিকার ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার রক্তে।তার অন্যতম পরিচয় পাওয়া যায় বাংলায় ৪০০ বছরের পাল বংশের বৌদ্ধ রাজত্বে।কারণ ধর্মসহিষ্ণুতা ছিল ভারতীয় জীবনচর্চার অঙ্গ। সেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংবিধানের ‘সেকুলার’ কথাটি সংযোজনের পরেই দেখা যায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ধান্দাবাজির পরিচয়। তার প্রমাণ পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় মদতে হিন্দুশূন্য হলেও ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত পর্যায়ে যা-ই হোক না কেন, সেকুলার কথাটির অর্থ, যথার্থ প্রযুক্ত হতে পারত যদি অন্তত রাষ্ট্র, ধর্মীয় ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুর নাম করে কোন সম্প্রদায় বিশেষের জন্য কোনওরকম পক্ষপাতমূলক আচরণ না করত।
এই সেকুলার শব্দটি কংগ্রেসি রাজের অতি ব্যবহারের হাতিয়ার না হলে আজ তার অন্তঃসারশূণ্যতা এমনভাবে প্রকট হত না। সেকুলারিজমের নলচে আড়াল করে ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব সেই নেহরুর আমল থেকে। সংবিধানে সমাজসংস্কারে যদিও Indian Code Bill করার অঙ্গীকার আছে, এই স্বঘোষিত Hindu by mistake নেহরু Hindu Code Bill আনলেন।তারপরে ইন্দিরা গান্ধির সেকুলারিজমের ভোটব্যাঙ্ক পলিটিক্সে বামপন্থী ধারায় হজ যাত্রীদের জন্য অনুদান শুরু হল।তারপরে আধুনিক মনস্ক রাজীব গান্ধী মুসলমানদের পুরুষতান্ত্রিক কায়েমি স্বার্থের কোরান অসমর্থিত এক অন্যায়কে আইনি আশ্রয দেওয়ার জন্য শাহবানু মামলায় সংবিধান সংশোধন করে ফেললেন। সত্য সেলুকাস, কী সেকুলার এই দেশ!
বিগত ৫০ বছর ধরে কংগ্রেসের স্লোগানসর্বস্ব বন্ধ্যা রাজনীতিতে উদীয়মান বিজেপির বিরুদ্ধে একটি বিকল্প কর্মসূচির অভাবে সেই সেকুলার ফ্রন্টের ধানাইপানাই শুরু হয়েছে। যে সংসদ একদিন জাতীয় বিষয়ে আলোচনা সদর্থক সভা ছিল সেটি এখন ‘পরাজিত সম্রাট’ লালকৃষ্ণ আদবানির dog in the manger policy -এর সংসদ বানচালের প্রহসনের অন্ধ অনুকরণ হয়ে চলেছে।অন্যদিকে সমাজের নিম্ন কোটি থেকে উঠে আসা নরেন্দ্র মোদি, গুজরাটে তার শাসনের কৃতিত্বকে অবলম্বন করে সারাদেশের জনগণের অভিভাবক হয়ে উঠেছেন। স্বদেশে তিনি যতই সমালোচিত হোন না কেন, বিদেশে প্রবাসী ভারতীয়দের সবাই দেখা যায় তিনি জনপ্রিয় নেতৃত্বের অধিকারী হয়ে যথেষ্ট উদ্দীপনার সঞ্চার করেছেন। সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে বলা যায়, এখনও মোদির এখন জনসমর্থনের কোন হানি হয়নি। কিন্তু তার বিপদ এসেছে স্বক্ষেত্র থেকে। গোরক্ষা নিয়ে গোপুত্রদের কুৎসিত মাতামাতি সারা দেশ জুড়ে সঙ্গতভাবে ধিক্কারের কারণ হয়েছে।
দেশের এই কঠিন সময়ে, সেকুলার ও গোরক্ষামূলক অর্বাচীনতার সঙ্গে সংগ্রামে, নৈতিক অবক্ষয় ও উন্নত ভারতের সম্ভাবনার যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংকল্প স্বাধীনতার শতবার্ষিকীতে দেশকে বিকশিত ভারত হিসেবে একটি সুস্থিত সমাজের ভিত্তির ওপর স্থাপন করা। তাই তিনি ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অনুরূপ আহ্বানে বলেছেন – আবর্জনা, দারিদ্র, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, জাতিভেদ ‘কুইট ইন্ডিয়া’,ভারত ছাড়ো।
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে, আশা করতে ক্ষতি কি, সকলের সমবেত চেষ্টায় ব্রিটিশদের মতোই এই অশুভ শক্তিগুলি একদিন ভারত ছেড়ে চলে যাবে।তিমির বিদারী উদার অভ্যুদয়-এ হবে নব ভারতের জয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য – মতামত লেখকের নিজস্ব। কোনওরকম বিতর্কের জন্য পত্রিকা দায়ী নয়।